
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার কৌশলও হয়ে উঠছে আরও পরিশীলিত। স্বনামধন্য ব্যক্তির নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার এই পদ্ধতিকে প্রযুক্তির ভাষায় বলা হয় ‘স্পুফিং’। আগে ল্যান্ডফোনের যুগে প্র্যাংক কলের মাধ্যমে এমন প্রতারণা হতো। তবে স্মার্টফোনের যুগে এসে এই সমস্যা আরও বেড়েছে। গত কয়েক বছরে, বিশেষত গত কয়েক মাসে এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেকেই। এখানে চারজন ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা এবং এমন পরিস্থিতিতে কী করবেন তা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
কেস স্টাডি ১: শিল্পপতির নামে প্রতারণা
দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান একদিন তাঁর এলাকার এক শিল্পপতির নামে ফোনকল পান। সেই শিল্পপতি দূরের এক হোটেলের বিল দিতে পারছিলেন না বলে বিকাশ করতে বলেন। প্রথমে প্রতারক খুব স্বাভাবিকভাবে শিল্পপতির পরিচয় দিয়ে কথা বলে এবং বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেয়। তারপর শিল্পপতির পিএস পরিচয় দিয়ে একজন ফোন করে বলে, ‘স্যারকে ২৫ হাজার টাকা পাঠাতে বলছেন, স্যারের ক্রেডিট কার্ড কাজ করছে না। ২৫ হাজার টাকা দিলে আগামীকাল ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেবেন।’ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে বিশ্বাস করলেও পরে টাকার কথা শুনে বিশ্বাস রাখতে পারিনি।’
কেস স্টাডি ২: জজের ফেসবুক হ্যাক
মো. আবুল হোসেন খান একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ। ২৮ জানুয়ারি তাঁকে পরিচিতজনের নামে এক ব্যক্তি ফোন করে ওয়ান টাইম পিন চায়। আবুল হোসেন পিন দিয়ে দেন। এরপর প্রতারক তাঁর স্মার্টফোন হ্যাক করে ফেসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে পরিচিতদের কাছে টাকা চাইতে শুরু করে। এখন আবুল হোসেনের মেয়ে বেনজির আনজুম সবাইকে ফোন করে সতর্ক করে দিতে ব্যস্ত। বেনজির বলেন, ‘এমন প্রতারণার মুখে যদি আমার বাবা পড়েন, তখন কেমন লাগে! সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলব।’
কেস স্টাডি ৩: ঔপন্যাসিকের নামে প্রতারণা
মূর্ছনা বিশ্বাস একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তাঁকে একদিন সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত এক ঔপন্যাসিকের নামে ফোন করেন এক ব্যক্তি। প্রথম দিকে সব বিশ্বাস করে কথা বলছিলেন মূর্ছনা। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন সেই ‘ঔপন্যাসিক’ সিলেটে এক উৎসবে গিয়ে বিপদে পড়েন এবং মূর্ছনাকে ফোন করে ১০ হাজার টাকা পাঠাতে বলেন। মূর্ছনা টাকা পাঠিয়ে দেন, কিন্তু পরে নম্বর বন্ধ পেয়ে বুঝতে পারেন প্রতারকের কবলে পড়েছেন।
কেস স্টাডি ৪: চিকিৎসকের নামে প্রতারণার চেষ্টা
চিকিৎসক এজাজ বারী চৌধুরীও এমন প্রতারণার চেষ্টার শিকার হন। তাঁকে এক চিকিৎসকের নাম করে প্রতারক চক্র ফোন করে এবং এক রোগীর কথা বলে টাকা চায়। এজাজ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত হন যে এটি একটি প্রতারণার চেষ্টা।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান বলেন, প্রতারকেরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বনামধন্য ব্যক্তির কণ্ঠ নকল করতে পারে। তিনি কিছু পরামর্শ দেন:
- ফোনকল যাচাই করতে ‘ট্রু কলার’ নামের অ্যাপ ব্যবহার করুন।
- অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলে সতর্ক থাকুন। পরিচিত ব্যক্তির কথা বললেও সরাসরি বিশ্বাস করবেন না।
- হঠাৎ করে টাকা বা সাহায্য চাইলে সতর্ক থাকুন।
- ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
- শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন এবং সন্দেহজনক লিংকে ক্লিক করবেন না।
আর্থিক লেনদেনে সতর্কতা
- ফোনে কেউ টাকা চাইলে সরাসরি আর্থিক লেনদেন করবেন না।
- ওটিপি, ব্যাংক তথ্য বা ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করবেন না।
- কল রেকর্ড করুন, মেসেজ সংরক্ষণ করুন এবং স্ক্রিনশট নিন।
- প্রতারণার শিকার হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিন।
স্পুফিং এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্রতারণা থেকে সুরক্ষিত থাকতে সচেতনতা ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার অপরিহার্য। নিজে সতর্ক থাকুন এবং অন্যদেরও সতর্ক করুন।