শবে বরাত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত রাত। এই রাতে মহান আল্লাহ তাআলা বান্দাদের জন্য দয়ার দ্বার উন্মুক্ত করে দেন এবং তাদের গুনাহ মাফ করেন। তাই মুসলমানরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটান। অনেকে নফল নামাজ আদায় করেন, কোরআন তিলাওয়াত করেন, তাসবিহ-তাহলিল করেন এবং আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত কামনা করেন।

শবে বরাত শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, এ রাত উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি ও বিতরণের প্রচলন রয়েছে। পরিবারের সদস্যরা হালুয়া, ফিরনি, রুটি, রোস্টসহ নানা ধরনের খাবার তৈরি করে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করেন।

ঢাকার শবে বরাতের ঐতিহ্য ‘বরাতি রুটি’

ঢাকার শবে বরাতের অন্যতম প্রধান ঐতিহ্য হলো ‘বরাতি রুটি’। এটি মূলত পুরান ঢাকার এক বিশেষ ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা শবে বরাতের সময় বিশেষভাবে তৈরি ও বিতরণ করা হয়। ১৯শ’ শতকের শেষের দিকে ঢাকার নবাবদের হাত ধরে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখনকার দিনে নবাবরা শবে বরাত বেশ আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপন করতেন। আলোকসজ্জা করা হতো, মিষ্টি বিতরণ করা হতো, আর তখন থেকেই বরাতি রুটির প্রচলন শুরু হয়।

বরাতি রুটি দেখতে সাধারণ রুটির মতো নয়। এগুলো নানা আকৃতির হয়ে থাকে—কোনোটি দেখতে কুলার মতো, কোনোটি মাছ, কুমির, পাখি বা ফুলের মতো। এসব রুটি তৈরিতে ময়দার সঙ্গে চিনির সিরা, ঘি ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়। ভেতরে মোরব্বা ও কিশমিশ ভরা থাকে, আর ওপরে কাচ, মার্বেল বা পুঁতি দিয়ে সাজানো হয়। এর ফলে রুটিগুলো দেখতে হয় অত্যন্ত নান্দনিক।

বরাতি রুটির বাজার

শবে বরাতকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার চকবাজার, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, মালেকা টোলা, লোহারপুল মোড়, রায় সাহেব বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় বরাতি রুটির বিশাল বাজার বসে। এসব জায়গায় বিভিন্ন ধরনের রুটি সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারা সাধারণত এগুলো কিনে আত্মীয়স্বজন ও শ্বশুরবাড়িতে পাঠান।

বরাতি রুটির দাম আকৃতি, নকশা ও মানভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। শুধু বরাতি রুটিই নয়, এ সময় সাধারণ বনরুটিরও প্রচুর চাহিদা থাকে। ফলে শবে বরাতের আগে ও পরের কয়েক দিন পুরান ঢাকার অলিগলিতে জমজমাট হয়ে ওঠে এসব খাবারের বাজার।

ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রচেষ্টা

বরাতি রুটির ঐতিহ্য বহু বছর ধরে চলে আসছে। ব্যবসায়ীরা জানান, মোগল আমল থেকেই এই খাবারের প্রচলন রয়েছে। চকবাজারের শাহী মসজিদের আশপাশের এলাকাগুলোয় এটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। যদিও আধুনিক সময়ে অনেক নতুন খাবার বাজারে এসেছে, তবুও বরাতি রুটির কদর পুরান ঢাকায় এখনো অটুট রয়েছে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনার প্রভাবের কারণে বরাতি রুটির বাজার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী জানান, করোনা মহামারির সময় বাজার একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর এখনো আগের মতো বেচাকেনা নেই। তবুও যারা পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চান, তারা প্রতি বছর বরাতি রুটি কিনে ও বিতরণ করে এই সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।

উপসংহার

শবে বরাত শুধুই একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাংলাদেশের, বিশেষ করে ঢাকার, একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। বরাতি রুটি এর অন্যতম প্রতীক। যুগ যুগ ধরে এই বিশেষ রুটি ঢাকার মানুষের কাছে শবে বরাতের আনন্দের স্মারক হয়ে আছে। সময়ের সঙ্গে বাজার পরিবর্তিত হলেও এই ঐতিহ্য এখনো অনেকের কাছে আবেগের বিষয়। তাই বরাতি রুটি শুধু একটি খাবার নয়, এটি ঢাকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।