
মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলায় আসামি সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে খালাস দিয়েছেন আদালত। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোছা. শাহীনুর আক্তার গত ১৪ জানুয়ারি এ রায় দেন। রায়ে আদালত বলেছেন, মামলায় অভির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি এবং কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই।
মামলার পটভূমি
২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর মডেল তিন্নি নিখোঁজ হন। ওই রাতেই বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর অবস্থিত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু-১-এর নিচে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। তবে তখন তাঁর পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। অজ্ঞাতনামা নারী হিসেবে তাঁকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ১৫ নভেম্বর পত্রিকায় নারীর ছবি প্রকাশিত হলে তিন্নির চাচা তাঁকে চিনতে পারেন। পরে কবর থেকে লাশ তুলে তিন্নির পরিচয় শনাক্ত ও ময়নাতদন্ত করা হয়।
এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
আদালতের রায়ের মূল বিষয়গুলো
১. প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর অভাব:
তদন্ত কর্মকর্তা ও সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক আদালতকে জানান, তিন্নি হত্যার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। তিনি আরও বলেন, সানজিদুল হাসান ইমনের জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমন আদালতে বলেছেন, তিনি অভিকে চেনেন না এবং তিন্নি হত্যার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
২. তিন্নি ও অভির সম্পর্ক:
আদালত রায়ে উল্লেখ করেছেন, সাক্ষীদের বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে যে তিন্নি ও অভির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। অভি ও তিন্নি একই বাসায় থাকতেন। তবে তিন্নি অভিকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছিলেন বা বিয়ে না করলে মিডিয়ায় সম্পর্কের বিষয় প্রকাশ করে দেবেন, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
৩. ঘটনার দিন অভির অবস্থান:
আদালত রায়ে বলেছেন, ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর অভি তিন্নির বাসায় অবস্থান করেছিলেন। তিন্নির বাসার গৃহকর্মী শেফালী আক্তার ও বীনার সাক্ষ্য অনুযায়ী, অভি সেদিন রাত থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত তিন্নির বাসায় ছিলেন।
৪. হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি:
আদালত বলেছেন, অভি তিন্নিকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে বুড়িগঙ্গা সেতু থেকে ফেলে দিয়েছেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। ঘটনার দিন অভির অবস্থান তিন্নির বাসায় ছিল, যা সাক্ষীদের বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে।
৫. সাক্ষীদের সাক্ষ্য:
তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম আদালতকে বলেছেন, তিন্নি অভির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন এবং অভি তিন্নিকে বিয়ে করার কথা বলেছিলেন। তবে তিন্নি ও অভির সম্পর্কে কোনো ফাটল বা অবনতি হয়েছিল, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
৬. তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য:
তদন্ত কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক আদালতকে জানান, তিনি ইমনের জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমন আদালতে বলেছেন, তিনি অভিকে চেনেন না এবং তিন্নি হত্যার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
আদালতের সিদ্ধান্ত:
আদালত বলেছেন, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আসামিকে শাস্তি দিতে হলে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয়। কেবল পলাতক হওয়ার কারণে কোনো আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। এ মামলায় অভির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
আপিলের সম্ভাবনা:
ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
এই রায় তিন্নি হত্যা মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া ও প্রমাণের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অভিযোগ প্রমাণের জন্য শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন, যা এই মামলায় অনুপস্থিত ছিল।
সূত্র: প্রথম আলো