
রাশিয়ার একনায়কতান্ত্রিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এতদিন পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের প্রতীক ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। চার্চিলের মতো দৃঢ় নেতার ভূমিকায়, তিনি ইউরোপকে নৈতিক অবস্থান নিতে বাধ্য করেছিলেন।
কিন্তু কিয়েভে গত বুধবারের এক মঞ্চে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্টের পাশে দাঁড়িয়ে জেলেনস্কিকে বেশ অসহায় মনে হচ্ছিল। তাঁর প্রত্যাশা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক হবে এবং শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি আসবে। ট্রাম্পও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তাঁরা শিগগিরই দেখা করবেন। কিন্তু বাস্তবে, জেলেনস্কির সাক্ষাৎ হলো কেবল মার্কিন প্রশাসনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সঙ্গে। আর তাঁর সামনে রাখা হলো একটি অর্থনৈতিক চুক্তির খসড়া, যাতে তিনি এখনো স্বাক্ষর করেননি।
অপরদিকে, মার্কিন অর্থমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত সফরের মধ্যেই জানা যায়, ট্রাম্প ব্যস্ত ছিলেন অন্য কাজে। তবে এই ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন।
পুতিনের সুযোগ, ট্রাম্পের কূটনৈতিক অগ্রাধিকার
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানাচ্ছে, দীর্ঘ তিন বছর ধরে পুতিন এমন একটি মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পশ্চিমা ঐক্যে ফাটল ধরবে এবং এখন মনে হচ্ছে, ট্রাম্প সেই সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন।
সম্প্রতি রাশিয়া মার্কিন বন্দী মার্ক ফোগেলকে মুক্তি দিয়েছে, যা ট্রাম্পের জন্য বড় এক কূটনৈতিক জয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি আমেরিকায় রাশিয়ার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে।
কিন্তু ইউক্রেনের জন্য পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীত। এক বছর আগেও ইউরোপের নেতারা জেলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে কিয়েভে ছুটে আসতেন। অথচ এখন ট্রাম্পের অগ্রাধিকার তালিকায় জেলেনস্কির চেয়ে পুতিনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ন্যাটো স্বপ্নের অবসান, ক্রিমিয়া ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই
পুতিন-ট্রাম্প ফোনালাপের বিস্তারিত জানা যায়নি, তবে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এটি ইউক্রেনের জন্য হতাশাজনক। নতুন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার হেগসেথ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন—ইউক্রেন কখনোই ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। তাঁর মতে, এটি একটি “অবাস্তব” পরিকল্পনা।
এমনকি ২০১৪ সালের আগের সীমান্তেও ইউক্রেনের ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ, রাশিয়ার দখলে থাকা ক্রিমিয়া আর কখনোই ইউক্রেনের হতে যাচ্ছে না। তদুপরি, যদি কোনো শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনও হয়, তাতেও যুক্তরাষ্ট্র থাকবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন হেগসেথ।
জেলেনস্কির নিরাপত্তা প্রত্যাশা ও ট্রাম্পের চুক্তির লক্ষ্য
জেলেনস্কির আশা ছিল, শান্তি প্রতিষ্ঠায় মার্কিন সেনারা কোনোভাবে ভূমিকা রাখবে। কারণ, তাঁর কাছে আমেরিকার নিরাপত্তা গ্যারান্টি ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথ এই ধারণাকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
এর পরিবর্তে, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল কিথ কেলোগের একটি পুরোনো প্রস্তাবের ভিত্তিতে নতুন একটি শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী—
- ইউক্রেনে একটি ইউরোপীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হবে।
- ইউক্রেনকে ন্যাটোর স্বপ্ন ভুলে যেতে হবে।
- যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হবে এবং পরে হয়তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
- ইউক্রেনকে দেওয়া আন্তর্জাতিক সহায়তা অনুদান নয়, বরং ঋণ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা কিয়েভকে পরিশোধ করতে হবে।
ট্রাম্প বহুদিন ধরে বলে আসছেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারতেন। তবে এখন তাঁর মূল লক্ষ্য পুতিনের সঙ্গে একটি চুক্তি করা। এই মুহূর্তে জেলেনস্কি শুধু অপেক্ষা করছেন, তিনি শান্তি আলোচনার টেবিলে কোথায় দাঁড়াবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের অগ্রাধিকারের শীর্ষে তিনি নেই—সেখানে আছেন পুতিন।